ছোটবেলা থেকে যখন আব্বাকে দেখতাম নৌকার মিছিল-মিটিংয়ে যাচ্ছেন, আমরাও নৌকা নৌকা করতাম। তারপর বুঝতে শিখলাম বঙ্গবন্ধু ও প্রাণের সংগঠন আওয়ামী লীগকে। বঙ্গবন্ধুকে জানতে গিয়ে জানা হলো কেমন করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারই স্বাধীন করা দেশের স্বাধীন মাটিতে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। ১৫ আগস্টের কথা কোথাও আলাপ হলে শুনতাম, মন খারাপ হয়ে যেত। খুব বেশি অপরাধী মনে হতো এই ভেবে— এমন একটি জাতির অংশ আমি নিজেও, যে জাতি তার পিতাকে হত্যা করেছিল।
সময়ের সঙ্গে বড় হয়েছি আর নিজেকেই প্রশ্ন করেছি— কেন এই কলঙ্কিত হত্যাকাণ্ডের বিচার এই মাটিতে হলো না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই জানলাম একটি কালো আইনের কথা, যে আইন দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আইনের মারপ্যাঁচ না বোঝা আমি বড়দের জিজ্ঞাসা করতাম, কেন এই আইন বাতিল করা যাবে না? কেন বিচার চাওয়া যাবে না? কারও কাছেই কোনো সদুত্তর পেতাম না।
মনে মনে শুধু ভাবতাম— কী এমন আইন যা বাতিল করা যায় না? কেন যায় না? কে-ই বা এই আইন করল? কেনই বা এই আইন এলো?
ইতিহাস পড়ে জেনেছি, ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ‘ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ’ নামক এই জঘন্য অধ্যাদেশ জারি করেছিল। ১৯৭৯ সালে সংসদে অধ্যাদেশটি একটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসেবে অনুমোদন পায়। আর ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে ওই সময়ের ইতিহাস জ্ঞান আমাকে যা জানায়নি বা জানতে দেয়নি সেটি হচ্ছে— খন্দকার মোশতাক আহমেদ বা তার সরকারই শুধু এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের জন্য দায়ী নয়। এর পেছনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ছিলেন আরও পরে ‘ঠাণ্ডা মাথার খুনি’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া ক্ষমতালোভী মেজর জিয়া।
১৯৭৫-এর ২৪ আগস্ট, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ৯ দিন পরই সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন জিয়াউর রহমান। ২৬ সেপ্টেম্বর মোশতাক সরকার যখন দায়মুক্তির আইন জারি করে, তখন তার সরকারকে সব ধরনের সমর্থন দিয়েছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সেনাবাহিনী। তাই সেনা সমর্থিত পুতুল সরকারের জারি করা আইনের দায় যে মেজর জিয়ার ওপরই বর্তায়, তা নির্মোহভাবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই জানা যায়। আর বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনায় যে মেজর জিয়া সামিল ছিলেন, সেই ইতিহাস তো এখন সবারই জানা। শুধু হত্যার পরিকল্পনাই নয়, বাংলাদেশের সংবিধান যেখানে প্রতিটি নাগরিকের হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়ার অধিকার দিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের জাতির পিতা হত্যার বিচারের সব পথ বন্ধ করার সব ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন জিয়া।
এই ‘ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ’-এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে শুরু হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতির। আইনি সুরক্ষা দিয়ে খুনিদের বিচারের পথই শুধু বন্ধ করা হয়নি, শাস্তির বদলে খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে করা হয়েছিল পুরস্কৃত।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে জয় পায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের পর ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদ ইনডেমনিটি আইনটি বাতিল করে। আর এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ তার জাতির পিতার হত্যার বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে।
এই দায়মুক্তি আইনটি কেবল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথই বন্ধ রাখেনি, দীর্ঘ ২১ বছর এই বিচারহীনতার সুযোগেই বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার সব ধরনের ষড়যন্ত্রই করা হয়েছিল। তবে যার হৃদয়টা ছিল হিমালয়ের সমান উঁচু, যার রক্তাক্ত শরীরটাই ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র, তাকে কোনো ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারেনি ষড়যন্ত্রকারীরা। তাই বলে এই ২১ বছরের বিচারহীনতার ইতিহাসও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এই কলঙ্কিত ইতিহাসও প্রতিটি প্রজন্মকে জানাতে হবে।
আর তাই আমার চাওয়া থাকবে, ২৬ সেপ্টেম্বর দিনটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো দিন হিসেবে পালন করা হোক। নতুন প্রজন্ম জানুক কতটা অবিচার করার হয়েছিল তাদের জাতির জনকের সঙ্গে, জাতির জনকের পরিবারের সঙ্গে।