এ কটি ভূখণ্ডের মৌলিক উপাদান হচ্ছে মানুষ। আর সংস্কৃতি হচ্ছে সেই মানুষের অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা এবং জ্ঞান, রীতিনীতি, নীতি-বোধ, চিরাচরিত প্রথা, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির সমষ্টিগত অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। বাংলা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হাজার বছরের বেশি পুরানো। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই সংস্কৃতির একটি প্রাচীন নিদর্শন—বৌদ্ধ দোহার সংকলন ‘চর্যাপদ’। বাঙালি তার ইতিহাসের প্রতিটি ধাপে নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বিকাশের মাধ্যমে তাদের স্বর্ণোজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছে। তারই ধারাবাহিকতায় আশির দশকে প্রথমবারের মত নববর্ষকে ঘিরে নিজস্ব সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছিল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামের আরেকটি অধ্যায়ের যেটি আজকে জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা পেয়েছে!
এ ঘোষণাটি যখন আসলো তখন দেশে বিরাজ করছে এক চাপা অস্থিরতার। বাঙালি মানেই এই ভূখণ্ডে সকলের সহাবস্থান। কিন্তু কিছু মানুষ সেটি ভুলে গিয়ে ধর্মের দোহায় দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে একে অন্যের উপর! ঠিক এই সময়টায় যখন কিনা দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্ম গুলিয়ে ফেলার অপচেষ্টা চলছে ঠিক তখন ইউনেস্কোর এই ঘোষণাটি আমাদের জন্যে একটি বড় অর্জন। তাই বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ যে, নানামুখি ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের উত্সব পহেলা বৈশাখকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে।
বাঙালি জন্মগত ভাবেই একটি উত্সব মুখর জাতি। যে কোনো উপলক্ষকেই উত্সবে পরিণত করতে আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি কুলিয়ে উঠতে পারবে না বলেই আমার ধারণা। পহেলা বৈশাখ বাঙালির সেই হাজার উত্সবের মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম একটি উত্সব। কারণ, এ উত্সবে মেতে ওঠে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। এ উত্সবে থাকে না কোনো হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ। শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশ-খচিত প্লাকার্ড। শোভাযাত্রার মুখোশের আড়ালে সবাই তখন এক এবং অভিন্ন। সব ধরনের রেসিজমের বিরুদ্ধে এ শোভাযাত্রা যেন একটি উপযুক্ত চপেটাঘাত!
দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে যদি রাষ্ট্র এবং জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকে তাহলে সেই রাষ্ট্র এক সময় মুখ থুবড়ে পড়ে। হয়ে যায় বিচ্ছিন্ন এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন। অন্যদিকে যে জাতি যত বেশি সংস্কৃতি-মনা সে জাতি তত বেশি সমৃদ্ধ। কোনো দেশের রাজনীতি যখন শিল্পকলার পক্ষে থাকে তখন সেই দেশের মানুষের অন্ধকারে পড়ে থাকার সময় থাকে না। কিন্তু এ দেশের কিছু মৌলবাদী শক্তি বাঙালির এই সরল সংস্কৃতির উপর বার বার আঘাত হানার চেষ্টা করেছে। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে জঙ্গি হামলা করেছে। এমনকি উত্সবকে বানচাল করতে নারীদের উপর উদ্দেশ্যমূলকভাবে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে গেল বছরই! প্রাণের এ উত্সবকে বলা হয়েছে হিন্দু-বাদিতা! কিন্তু বাংলার সহজ সরল আপামর জনসাধারণকে কোনোভাবেই ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। যার ফলশ্রুতিতে আজকের জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি।
দেশের ঐতিহ্যবাহী চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতি বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে নানা রকম মুখোশ ও দেশের জাতীয় প্রতীকগুলোকে তুলে ধরেন। সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হচ্ছে, মুখোশ-প্লাকার্ড বানানোর খরচটাও এ ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন চারু সামগ্রী বিক্রয় করে সংগ্রহ করে থাকেন। তাই, ইউনেস্কো কর্তৃক world intangible cultural heritage ঘোষণাটির কৃতিত্বটি তাদেরই প্রাপ্ত। সেই সঙ্গে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই বাংলার সংস্কৃতিকে পুরো বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে।