১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামে বিজয়ী বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলেও বাঙালি জাতি স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছিল সেদিন, যেদিন তাদের অবিসংবাদিত নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তি লাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার মাটিতে পা রেখেছিলেন।
পাকিস্তানে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে পরাজিত পাকিস্তানি সরকার মুক্তি দেবে কি-না তা নিয়ে চলছিল জল্পনা-কল্পনা। যুদ্ধ জয়ের পরও তাই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র প্রস্তুত রেখেছিল তাদের জাতির পিতার মুক্তির জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি ছিল, তারা যে মহান নেতার নির্দেশে দেশ স্বাধীন করেছিল সেই নেতার হাতেই তাদের অস্ত্র জমা দেবেন। তার আগ পর্যন্ত তারা যুদ্ধ শেষ হয়েছে মনে করেননি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, যুদ্ধে বিজয়ের ২৪ দিন পর সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ইতিহাসের মহানায়ক, বাঙালি জাতির পিতা তার গড়া স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন বিজয়ীরবেশে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ওই রাতে তিনি আটক হবেন জানার পরও পালিয়ে যাননি শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে যেন বিশ্ববাসী কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর আন্দোলনের সাথে তুলনা না করতে পারে। তাই তখনই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। সেই রাতেই বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধও ছড়িয়ে পড়ে সেই রাত থেকে, শুরুটা হয়েছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের সাহসী পুলিশ সদস্যদের হাত ধরে। তবে আমাদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম আরো আগে থেকেই।
স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন মানুষের মনে গেঁথে দিতে হয়েছে, স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে জাতিকে দীক্ষিত করতে হয়েছে ধাপে ধাপে। হঠাৎ একদিন আমরা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দেওয়া শুরু করিনি, আমাদের রক্ত দিতে প্রস্তুত করা হয়েছে, তা সুনিপুণভাবে করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার পথপ্রদর্শক। তার নেতৃত্বগুণেই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার সূর্য উঠাতে পেরেছিলাম আমরা। বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী কবিতাটি বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চই আমরা জেনে গিয়েছিলাম আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য কি।
১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর লাখো জনতা তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে খোলা ট্রাকে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে যায় বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধু সেখানে সদ্য স্বাধীন জাতির উদ্দেশে প্রায় ২০ মিনিট আবেগঘন ভাষণ দেন। ‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।’ রেসকোর্স ময়দানের এ ভাষণটি ছিল আমাদের জন্য দিকনির্দেশনা। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো কেমন হবে তা এদিনই জানিয়েছিলেন তিনি। আবারও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন কেন আমরা এত ত্যাগ দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম – ‘এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মা-বোনেরা ইজ্জত ও কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণতা হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’
বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন তার রূপরেখা কেমন হবে তাও তিনি তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনই জানিয়ে ছিলেন– ‘এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা, এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র, এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’ ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির পিতা এ স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্যই কাজ করে যাচ্ছিলেন।
একই সাথে তার স্বপ্নের বাংলাদেশ যেন মাথা তুলে কোনো দিনই দাঁড়াতে না পারে সেই চক্রান্তও চালিয়ে যাচ্ছিল পাকিস্তানের পরাজিত প্রেতাত্মারা। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে যে সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেশের মানুষকে দেখিয়েছিলেন তা অর্জন করতে যে খুব বেশি সময় লাগবে তা বুঝতে পেরেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানের দোসর পরাজিত শক্তিরা ইতিহাসের ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে জাতির পিতাকে হত্যা করে, বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেয় তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ছুঁয়ে দেখার আগেই। আজকের বাংলাদেশ ২০২০ এ এসে যেভাবে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে চাচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে, সেই লক্ষ্যে আমরা হয়তো আশির দশকেই পৌঁছে যেতাম যদি না জাতির পিতাকে হত্যা করে আমাদের দীর্ঘ সময় পরিকল্পিতভাবে অন্ধকারে না ফেলে রাখা হতো।