সংকটে ভেদহীন সিদ্ধান্তই কেবল সমষ্টির কল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের যেমন দেশের সকল সেক্টর নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে তেমনই জনগণকেও সরকারের সীমাবদ্ধতাসহ নিজ নিজ দায়িত্ব নিয়ে ভাবতে হবে। সরকারকে যেমন করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে, তেমনই জনগণকেও কিছুদিন স্বাচ্ছন্দ্য পরিহার করে অসুবিধা স্বীকার করে নেয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। অর্থাৎ সবাইকে সবার সমস্যা বুঝার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সবদিক দেখতে হবে সমান দৃষ্টিতে। কাউকে দোষ দেয়া, কারো ওপর দোষ চাপানো এখন সংকট মোকাবিলায় কাজে আসবে না।
ভয়ানক এক ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব। আমরাও প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছি প্রাণঘাতী এ ভাইরাস মোকাবিলা করে টিকে থাকার। তারপরও চারপাশে লেগেছে মড়ক। মানুষ মরছে প্রতিদিন, আগের দিনের চেয়েও বেশি। পরিচিত আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই লড়াই করছে মৃত্যুর সঙ্গে। তবু থেমে থাকার উপায় নেই। হার না মেনে সামনে চলতে হবে। এই মহামারিকে সঙ্গে নিয়েই আগামী দিনে বেঁচে থাকার পথ খুঁজতে হবে। নববর্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন-
“আপনাদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকার সব সময় আপনাদের পাশে রয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর আমি দরিদ্র-নিম্নবিত্ত মানুষদের সহায়তার জন্য কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি। আমরা ইতোমধ্যে পল্লী অঞ্চলে কর্মসৃজনের জন্য ৮০৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং পবিত্র রমজান ও আসছে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৬৭২ কোটিরও বেশি টাকা বরাদ্দ দিয়েছি। এর দ্বারা দেশের প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ ৪২ হাজার নিম্নবিত্ত পরিবার উপকৃত হবেন। গত বছর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে ভিজিএফ, টেস্ট রিলিফসহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।”
সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব রকম চেষ্টা করে যাচ্ছে। করোনা মোকাবিলায় যে সাফল্য, যে সাহস দেখিয়েছে বাংলাদেশ, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ তা পারেনি। তারপরও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আমাদের ধারণার চেয়ে প্রবল বেগে আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে। প্রতিদিনই আক্রান্ত আর মৃত্যুর রেকর্ড করছে দেশ। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকার আবারও লকডাউনের মাধ্যমে দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করতে চাইছে। সর্বাত্মক লকডাউন কার্যকর করে করোনা বিস্তারের গতি রোধ করতে চাইছে। বরাবরের মতো এবারের লকডাউন নিয়েও জনমনে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন প্রশ্ন। বিভিন্নরকম বিভ্রান্তিও ছড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের একজন হিসেবে লকডাউন এবং এর কার্যকারিতা নিয়ে আমার মনেও কিছু প্রশ্নের উদয় হয়েছে। শিল্প কলকারখানা চালু রেখে কীভাবে একটা কার্যকর লকডাউন সম্ভব? যেখানে এই সেক্টরের কর্মীরা সমাজের একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষ। অধিকাংশই পরিবার গ্রামে রেখে শহরে অনেকে মিলে গাদাগাদি করে মেসে থাকে। একটা অংশ থাকে বস্তিতে। তারা আগের মতোই কর্মক্ষেত্রে গেলে কীভাবে লকডাউনের সুবিধা আমরা পাব? কারখানা মালিকরা কীভাবে পারবে তাদের কর্মক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বাস্তবায়ন করতে? এরকম কিছু প্রশ্ন সচেতন মহলের মনে উদয় হয়েছে।
আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না। এমন পরিস্থিতিতে আমরা যে প্রতিবছর পড়ি তা নয়। তবে গত বছর পড়েছিলাম। আমাদের অভিজ্ঞতা একেবারে যে নেই তা নয়। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা এবার হয়ত কিছুটা ভালো করতে পারতাম। আমরা পারতাম এসব শ্রমিকের অন্তত এক সপ্তাহের অন্ন-সংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়ে তাদের বলতে, ঘরে থাকুন। কর্মীদের এক সপ্তাহ ঘরে বসিয়ে খাওয়ানো বাংলাদেশের শিল্প কারখানার মালিকদের কোনো ব্যাপার নয়। সরকার শিল্পখাতে অনেক দিচ্ছে।
গত বছর তারা যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই প্রণোদনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আরেকটি বিষয় আমাদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। লকডাউন যেহেতু দিতেই হবে, তখন একটা জরুরি বৈঠক ডেকে, সবার সঙ্গে সমন্বয় করে, নীতিমালাগুলো ঠিক করে তারপর কী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জনগণকে জানানো যেত না? তাহলে তো মানুষ এত বিভ্রান্ত হতো না। এক ব্যাংকিং সেক্টরের জন্যই ঘণ্টায় ঘণ্টায় ব্রেকিং নিউজ দিয়ে নিয়ম পাল্টালে সিদ্ধান্তহীনতার ছাপ স্পষ্ট হয়। এতে সাধারণ মানুষের আস্থায় ঘাটতি তৈরি হয়। তারা কর্তাদের সক্ষমতা হীনতার চিত্র স্পষ্ট বুঝতে পারে। সম্প্রতি রাজপথে একজন চিকিৎসক ও পুলিশের বাগবিতণ্ডার খবরও দেখছি। এসব কাম্য ছিল না।
লকডাউন নিম্ন আয়ের বা দিনমজুর শ্রেণির অন্নসংস্থান কীভাবে হবে সে ব্যাপারে কোনো ভাবনা নীতিনির্ধারকরা ভেবেছেন কি না এ নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন উঠেছে। লকডাউনে কার ক্ষতি কার লাভ জানি না, তবে এটুকু জানি যে আগে মানুষকে বাঁচতে হবে। বাঁচাতে হবে।
ভোটের সময় যেভাবে তালিকা করে মানুষের ঘরে ঘরে যাওয়া হয়, ঠিক সেভাবেই প্রতিটা এলাকার জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব নেয়া উচিত যেন তারা তাদের এলাকার প্রতিটা মানুষের খোঁজ নেয়। ভোট আসলে দুই সপ্তাহে গোটা নির্বাচনি এলাকার প্রতিটি বাড়িতে যেতে পারেন রাজনীতিবিদরা। এবার কেন পারবেন না?
দরিদ্রদের তালিকা করে তাদের এই লকডাউনে বেঁচে থাকার মতো খাবার তাদের হাতে পৌঁছে দেয়ার কর্মসূচি সরকার গ্রহণ করতে পারে। প্রতিটা এলাকার দায়িত্ব জনপ্রতিনিধিরা নিতে পারেন। পাশাপাশি অন্যান্য ব্যবস্থা যেমন কল সেন্টার চালু করা, প্রতিটা নাগরিকের জরুরি চাহিদা ঘরের দরজায় পৌঁছে দিত, তাহলে তো এমনিতেই কঠোর লকডাউন হয়ে যেত। কিন্তু আমরা গতবছরও এমনটা করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। এক বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে এবার কি সফল হয়েছি? না হইনি।
একইভাবে আমরা সাধারণ জনগণও ব্যর্থ হচ্ছি। আমরা কারো কোনো কথা শুনি না। সরকারি কোনো নির্দেশ তা যত ভালোই হোক না কেন আমরা তা মানছি না। অথচ সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিটা মেনে চললে হয়তো করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউটা আমাদের মোকাবিলা করতেই হতো না। সরকার সব বন্ধ করলেই আমরা আন্দোলনে নামি।
সরকার যে সিদ্ধান্তই নিক আমাদের তার বিরোধিতা যেন করতেই হবে। সরকার, সরকারি সিদ্ধান্ত সব বাদ দিন, অন্তত নিজের আর নিজের পরিবারের জন্য হলেও স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব এসব মেনে চলুন। অনেকেই প্রতিদিন এত মানুষ মারা যাচ্ছে বলে দুঃখ প্রকাশ করার পরক্ষণেই তিনি নিজে স্বাস্থ্যবিধি ভাঙেন। এরকম স্ববিরোধিতা ভয়ংকর।
সরকারের একার পক্ষে এত বড় মহামারি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। কারণ এটি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের হাত থেকে নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, যে সরকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োগ করে সবাইকে শায়েস্তা করে দেবে!
করোনাভাইরাস হলো এক অদৃশ্য শত্রু। যাকে দেখা যায় না, যার আগমন নির্গমন বোঝা যায় না, অথচ মানুষের প্রাণ নিয়ে নেয়। এ অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা সহজ কাজ নয়। একটি ছোট দেশ হিসেবে আমাদের দুর্বলতা ও সক্ষমতার বিষয়টিও বুঝতে হবে সবাইকে। করোনা মোকাবিলায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে যার যার জায়গা থেকে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বিশ্বের প্রায় সকল বিশেষজ্ঞই বলছেন, ওষুধের চেয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনাই পারে করোনা ভাইরাসকে মোকাবিলা করতে। এটি এমন একটি ভাইরাস যা সহসাই পৃথিবী থেকে বিদায় হবে না। বহুদিন এর বিপক্ষে লড়াই করেই টিকে থাকতে হবে পৃথিবীকে। এ জন্য ডাক্তাররা পরামর্শ দিচ্ছেন নিয়মিত মাস্ক পরিধান করার, বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার এবং কমপক্ষে ১ দশমিক ৮ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করার।
করোনা মোকাবিলায় এ পরামর্শগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে। সব দায় সরকারের ওপর চাপালে চলবে না। আমরা যত তাড়াতাড়ি সচেতন হবো, তত তাড়াতাড়ি লকডাউনের মতো পদক্ষেপগুলো অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এসে গেলে লকডাউনের মতো পদক্ষেপ কেন নিতে যাবে সরকার? এরইমধ্যে পরিস্থিতি তো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ঘোষণাও দিয়েছিল সরকার। কিন্তু আকস্মিক করোনার এ দ্বিতীয় ঢেউ সব উলটপালট করে দিলো। আবারও সব স্থবির করে দিলো। এখন সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও সচেতনতাই পারে পরিস্থিতিকে আবারও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে। সরকারের প্রচেষ্টার কোনো কমতি নেই। বাকি যেটুকু, তা এখন করতে হবে আমাদেরকে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচলের বিকল্প নেই। প্রত্যাশা করি, অল্পদিনের মধ্যেই আবার আমরা ফিরে পাব আগের সুস্থ-সবল, স্বাভাবিক বাংলাদেশ।