মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার চালা গ্রামের পিডাব্লিউডি কর্মচারী তৈয়ব আলীর চার ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় ছেলেটির ডাকনাম পিয়ারু, তবে মিন্টু নামেই বেশি চিনত সবাই। চালচুলোহীন সেই মিন্টুই আজকের কুখ্যাত রাজাকার মীর কাসেম আলী। কাসেম আলী মানিকগঞ্জের ছেলে হলেও তাঁর পিতার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামে স্থানান্তর হয়েছিলেন স্বাধীনতার আগেই। চট্টগ্রামে কলেজে পড়া অবস্থায় তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংঘে যোগ দেন, যেটি পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পাকিস্তানপন্থীদের পক্ষে দালালি এবং চাটুকারিতার অনন্য উদাহরণ ছিলেন মীর কাসেম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সেই অনন্য চাটুকারিতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে রাজাকার বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। অর্থাৎ চট্টগ্রাম জেলার সব রাজাকারী কর্মকাণ্ডের মূল হোতা ছিলেন এই মীর কাসেম।
তাঁর রাজাকারী কর্মকাণ্ডের হিসাব আসলে খাতা-কলমে শেষ করা যাবে না। একটা মানুষ ঠিক কতটা পশু হলে এতটা বর্বর হতে পারে, তা চিন্তা করলে গা শিউরে ওঠে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলের লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা শুনে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল এটিকে ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ বা মৃত্যু কারখানা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, ‘আলবদর সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের আমৃত্যু নির্যাতন করার উদ্দেশ্যে ডালিম হোটেলে ধরে নিয়ে আসত। এটা প্রমাণিত যে এ হোটেলে আলবদর সদস্যদের পরিচালনা ও নির্দেশনা দিতেন মীর কাসেম আলী নিজে। হোটেল সত্যিকার অর্থেই ছিল একটি ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’।
১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি ছিলেন মীর কাসেম। নভেম্বরের ৮ তারিখে কাসেম আলী পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের ‘সাধারণ সম্পাদক’ নির্বাচিত হয়ে ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে ‘আলবদর’ বাহিনী গঠন করেন। তারপর সেই বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন একের পর এক বর্বর হত্যাকাণ্ডে। ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধী সমাবেশ আয়োজন করা হয়। সভাপতি হিসেবে তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, ‘গ্রামেগঞ্জে প্রতিটি এলাকায় খুঁজে খুঁজে পাকিস্তানবিরোধীদের শেষ চিহ্নটি মুছে ফেলতে হবে।’ তাঁর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী নগরের তৎকালীন টেলিগ্রাফ অফিসের পাশে মহামায়া ভবন দখল করে তার নাম পাল্টে ডালিম হোটেল রেখে সেটিকেই টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নৃশংসতার নির্মম সাক্ষী এই ডালিম হোটেল থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ১৭ ডিসেম্বর সাড়ে ৩০০ বন্দিকে প্রায় মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। প্রতিদিন প্রায় অর্ধশত বাঙালিকে ডালিম হোটেলে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন পরও ডালিম হোটেলের আশপাশ এলাকায় অসংখ্য লাশ পড়ে ছিল।
স্বাধীনতার পর মীর কাসেম পালিয়ে ঢাকা চলে আসেন। মিন্টু নামে নিজের পরিচয় দিতে ঘৃণ্য এ রাজাকার, নিজেকে বলতেন মুক্তিযোদ্ধা! কিন্তু চিহ্নিত হয়ে পড়ার পর আরেক ঘাতক মঈনুদ্দীনের সঙ্গে পালিয়ে যান লন্ডন। সেখান থেকে সৌদি আরব। ‘ধনকুবের’ শব্দটি ঠিক তখন থেকেই তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। এই নরপিশাচ সৌদি আরবে যাওয়ার পর সেখানের মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের একত্রিত করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মুসলমানদের জন্য আর্থিক সহায়তা, মসজিদ নির্মাণ ইত্যাদির কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। মুসলমানদের পবিত্র স্থান সৌদিতে গিয়েও এই নরপিশাচ ধর্মকে বিক্রি করেছেন। পরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে দেশে ফেরেন ওই কুখ্যাত রাজাকার। মোশতাক সরকার মুজিবের ঘাতকদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির পাশাপাশি প্রত্যাহার করে নেন দালাল আইন। জিয়ার শাসনামলে নতুন করে সংগঠিত হয় ইসলামী ছাত্রসংঘ, নাম বদলে হয় ইসলামী ছাত্রশিবির। ছাত্রশিবিরের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি হন মীর কাসেম আলী। এরপর রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের নামে রাবেতা আল ইসলামী গড়ে তোলেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর টাকায় আস্তে আস্তে বানান ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস। জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের আয়ের এবং কর্মসংস্থানের বড় উৎস হয়ে দাঁড়ায় এসব প্রতিষ্ঠান।
বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন মীর কাসেম। তাঁর সরাসরি নির্দেশনা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছিল বলে জানা যায়।
বিএনপি-জামায়াত জোট যখন ক্ষমতায়, তখন এই ঘৃণ্য রাজাকারদের দল উপহাস করে দাবি করেছিল, তাদের বিচার কেউ করতে পারবে না। মীর কাসেম আলীর ক্ষেত্রে এর একটি কারণ হতে পারে তাঁর অবৈধ অর্থ। জামায়াতের অর্থনৈতিক দিকটি মূলত মীর কাসেমের হাতেই ছিল। বিপুল অর্থের মালিক রাজাকার কাসেম তাঁর বিচার ঠেকাতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি। কোটি কোটি টাকা দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ, জঙ্গিবাদে দেশ অস্থিতিশীল করে তাঁর বিচারকার্য ব্যাহতসহ যাবতীয় চেষ্টা করেছেন। কিন্তু টাকা দিয়ে তো আর সব কিছু হয় না। তাই এবার নতুন বাহানা ধরেছেন যে তাঁর ছেলেকে এনে দিলে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয় ভেবে দেখবেন! কী অদ্ভুত আবদার! তাঁর মৃত্যুদণ্ড রায় হওয়ার পর তিনি এবং তাঁর দল নতুন স্ট্র্যাটেজি নিয়ে মাঠে নেমেছে। হয়তো এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে তাদের জোটসঙ্গী বিএনপিও জড়িত থাকতে পারে।
কারণ অনেক দিন ধরেই বিএনপি গুম-গুম খেলা খেলে আসছে। তাদের নেতাকর্মীদের টাকা দিয়ে গুম থাকতে বলে সরকারের ওপর দোষ চাপাচ্ছে, যা এখন প্রমাণিত। সম্প্রতি হলি আর্টিজানের ঘটনার পর গুমের আসল ঘটনাও বের হয়ে আসছে। কারণ গুমের আড়ালে যে জঙ্গি তৎপরতা চলছিল তা গোয়েন্দারা বের করে ফেলেছে। এর আগে বিএনপির সালাহ উদ্দিনের ঘটনা এখন সবাই জানে। বিএনপি দাবি করে আসছিল যে সরকার তার বাহিনী দিয়ে সালাহ উদ্দিনকে গুম করে রেখেছে। কিন্তু পরবর্তী সময় ভারতের পুলিশ সালাহ উদ্দিনকে ভারত থেকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের হেফাজতে রেখেছে। শোনা যায়, বিএনপির ইলিয়াস আলীও রয়েছেন ভারতের কোনো এক কারাগারে। বিএনপি-জামায়াত জোটের এসব গুমের নাটক নতুন নয়। নিজেদের সুবিধা হাসিল করার জন্য তারা যেকোনো সময় যে কাউকে গুম করে দেয়। মীর কাসেম আলীর ছেলে গুম হওয়ার পেছনেও কি রয়েছে নতুন কোনো ষড়যন্ত্র? আশা করছি সেই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কী আছে সেটিও খুব দ্রুত সামনে আসবে।