আজ ১৭ মে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৮১ সালের এই দিনে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ফিরে এলেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে। এদেশের ভাগ্যাকাশে যখন দুর্যোগের কালো মেঘের ঘনঘটা, ক্যু-হত্যা যখন নিত্যনৈমত্তিক, জাতি যখন নেতৃত্বশূন্য ও লক্ষ্যভ্রষ্ট, তখনই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। সেদিন তাঁকে স্বাগত জানাতে ঢাকায় সমবেত হয় লাখো মানুষ।
প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই লাখো মানুষ বঙ্গবন্ধুকন্যাকে স্বাগত জানায়। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয় ঢাকার রাজপথ। দেশে ফিরে বিমানবন্দরে লাখো জনতার উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’
স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর বঙ্গবন্ধুকন্যা অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘…আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থেকে আমি ঘর-সংসার করছিলাম। কিন্তু সবকিছু হারিয়ে আপনাদের মাঝে এসেছি। বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি এদেশ আমার মাতৃভূমি এদেশকে নিয়ে আমার সমস্ত আশা ভরসা বাংলার মানুষের পাশে থেকে সমস্ত সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি এদেশে ফিরে এসেছি। এবং আমি আপনাদের পাশে থেকে বাংলার মানুষের হৃদয়ের ভালোবাসা অর্জন করতে চাই। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার এ জীবন দান করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ছোটভাই রাসেলসহ সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই।’
১৯৭৫ সালে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘদিন প্রবাসে নির্বাসন কাটিয়ে দেশে ফিরে জাতির জনককে হারিয়ে বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বের সুবাদে আওয়ামী লীগ তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় শুধু আমাদের দেশ বা আমাদের এই অঞ্চলেরই নন, গোটা বিশ্বেরই একজন বিশিষ্ট রাষ্ট্রনেতা হিসেবে দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি লাভ করেছেন তিনি ।
তাঁর দূরদৃষ্টি, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমে দেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি অর্জনসহ মাথাপিছু আয় বাড়ছে, কমছে দারিদ্র্যের হার। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। দেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে তিনি ‘ভিশন ২০২১’ ও ‘ভিশন ২০৪১’ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণে শেখ হাসিনার এসব যুগান্তকারী কর্মসূচি বাংলার ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
১৯৮১ সালে এই দিনে ৩৪ বছর বয়সের পিতৃ-মাতৃহারা তরুণী শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই যখন বাংলার মাটিতে পা রাখলেন, তখন তার আপন রক্তের ‘কোথাও কেউ নেই’। এ বাংলার মাটিতে কয়েক বছর আগেও তার বাবা-মা, চাচা, ভাই সবাই ছিল। আজ তারা কেউ নেই। কী নির্মম, নিষ্ঠুর কাহিনী। আমার জানা নেই, বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে এমন ট্র্যাজেডির শিকার কোনো রাজনৈতিক পরিবার হয়েছে কিনা?
কথা-কাজে-প্রতিজ্ঞা প্রতিটি পদক্ষেপে, নীতি-কৌশলে কন্যা ছিলেন ঠিক বাবার মতোই। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে প্রথম দিন তিনি জনগণকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আজও প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে দেশকে আত্মনির্ভরশীল, সুখীসমৃদ্ধ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সম্পন্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আজ বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে সমাদৃত। এখানে পৌঁছতে তাঁকে অনেক চ্যালেঞ্জ আর বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, কারাগারে থেকেছেন। ২০০৭ সালে সাবজেলে তার নিঃসঙ্গ বন্দিজীবন কেটেছে। একের পর এক হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে। প্রহসনমূলক বিচারের আয়োজন হয়েছে। রাজনীতি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর কিংবা দেশের বাইরে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টাও হয়েছে।
২৪ বার তার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, যাতে নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন ঘটনাস্থলে প্রাণ হারিয়েছেন, আর আহত হলেন শতশত।
সেই দুর্যোগময় সময় অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের আর কোনো দেশ উন্নতির এমন অসাধ্য সাধন করতে পারেনি, যেমন পেরেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাও একসময় অসাধ্য ছিল কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তা সম্ভব হয়েছে। একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে, নিম্নমধ্য আয়ের পথ পেরিয়ে, উন্নত বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার দিকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলার কাণ্ডারি, দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের উন্নতি এখন বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। বাংলাদেশের এই অভাবনীয় অগ্রগতির মূল কারণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব। শেখ হাসিনার সরকার নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার দেখিয়ে দিয়েছে বাঙালি সবই পারে, আমরাও পারি। বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই সেতুটি। অথচ এই সেতুটি নির্মাণ করতে গিয়েও সরকারকে অনেক দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হয়েছে। ইতোমধ্যে সেতুর ৪৩ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে।
জাপান আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থার (জাইকা) সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে ২২ হাজার কোটি টাকার ‘মেট্রোরেল’ প্রকল্প ২০১৯ সাল নাগাদ বাস্তবায়িত হবে। দেশের অভ্যন্তরে সর্বক্ষেত্রেই এই সময়ে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। যোগাযোগ ক্ষেত্রে সারাদেশের চিত্রই পাল্টে গেছে। ঢাকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে সব মহাসড়কই চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে।
মিরপুর-এয়ারপোর্ট ফ্লাইওভার, বনানী ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার, যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার প্রভৃতি প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে হাতিরঝিলের মতো দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। পিছিয়ে নেই, অভিবাসন ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। ইন্টারনেট ব্যবহারে সহজলভ্যতা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য, দুর্যোগ মোকাবেলা, কৃষি উন্নয়ন, শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট পাঠিয়ে বাংলাদেশ মহাকাশেও রচনা করেছে বিজয়গাথা। এখন ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট অধিকারীর তালিকায় লেখা থাকবে বাংলাদেশের নামও।
যতদিন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে থাকবে-পথ হারাবে না বাংলাদেশ। জয়তু শেখ হাসিনা।