জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে নারীর ভূমিকা

PIN জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে নারীর ভূমিকা

ফতোয়া একটি আরবি শব্দ, যা কোরআন-সুন্নাহ তথা ইসলামী শরিয়তের একটি মর্যাদাপূর্ণ পরিভাষা। দ্বীন-ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসার পর একজন দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে প্রাজ্ঞ মুফতি কোরআন-হাদিস ও ইসলামী আইনশাস্ত্র অনুযায়ী যেই সমাধান দেন তাই ‘ফতোয়া’। সম্প্রতি ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে চলমান জঙ্গি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো লক্ষাধিক আলেমের ফতোয়া জারি হয়েছে। ফতোয়ায় সর্বসম্মতভাবে এক লাখ আলেম ও মুফতি ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ ও আত্মঘাতী হামলাকে হারাম বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহর ইমাম ও খতিব আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের নেতৃত্বে ফতোয়াটিতে মোট এক লাখ এক হাজার ৮৫০ জন আলেম ও মুফতি স্বাক্ষর করেছেন, যার মধ্যে প্রায় ১০ হাজার নারী আলেম স্বাক্ষর করেছেন! বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে এত নারীর উন্মুক্ত অংশগ্রহণ অত্যন্ত প্রশংসার দাবিদার।

এখানে একটি বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য যে সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলন এখন আর কোনো নির্দিষ্ট গোত্র বা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা নাড়া দিয়েছে সবাইকে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে। সাধারণ নারীদের মধ্যেও জঙ্গিবাদ ও টার্গেট কিলিং নিয়ে সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রতিফলন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এই ১০ লাখ স্বাক্ষর।

সম্প্রতি ক্রসফায়ারে নিহত জঙ্গি ফাহিমের অতীত জানলাম পত্রিকা মারফত। ছেলেটি নাকি বেশ শান্ত স্বভাবের ছিল। নামাজ পড়ত। সবচেয়ে বড় কথা, সে এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিল। ছেলেটির শিক্ষকরা আশা করেছিলেন এইচএসসিতেও একই রকমের রেজাল্ট করবে। কিন্তু হায়! ফলাফল প্রকাশের আগেই জঙ্গিবাদের ছোবলে ঝরে গেল সেই আশার ফুল। ফাহিমের মা-বাবা যদি ছেলের সঠিক খোঁজখবর রাখতেন তবে হয়তো ছেলেকে অকালে হারাতে হতো না। বিশেষভাবে মা। অবাধ স্বাধীনতার নামে আজকাল ছেলেমেয়েরা কোথায় কী করছে তা বেশির ভাগ মাই খোঁজ রাখেন না কিংবা রাখতে পারেন না। কিন্তু সঠিকভাবে সন্তানের খোঁজখবর রাখলে এমন ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।

জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো যে স্লিপার সেল তৈরি করছে তা এখন মাদ্রাসা কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ নয়। জঙ্গিরা ঢুকে পড়েছে দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। সেখানে তারা টার্গেট করছে মেধাবীদের। সেই হীরক রাজার মতো ‘যন্তর মন্তর ঘরে’ ঢুকিয়ে ব্রেইনওয়াস করছে। তারপর ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। এ ক্ষেত্রে মায়েরা যদি সন্তানদের গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখেন, ছেলে কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে মিশছে, রাতে অন্য কোথাও পড়ার নাম করে থাকছে কি না—এসব খোঁজখবর রাখেন তাহলে সেই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো বেশি দূর এগোতে পারবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পারলাম, যে আলেম ও আলেমারা ফতোয়া দিয়েছেন এতে তাঁরা জঙ্গিগোষ্ঠী কর্তৃক হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে নারী আলেমদের ওপর রোষানলটা একটু বেশি হতে পারে। সেই জঙ্গিরা বোঝে না যে যার বা যাদের ছেলেমেয়েদের দিয়ে এই সন্ত্রাসী কার্যক্রম করাচ্ছে সেসব তরুণ-তরুণী কোনো না কোনো মায়ের সন্তান। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে, লালন-পালন করেছে অনেক আশা, স্বপ্ন নিয়ে। আর তার সন্তানকে আপনি এভাবে ভুল বুঝিয়ে, ভুল পথে নিয়ে যাবেন আর মা, মেয়ে, বোন, স্ত্রী সর্বোপরি একজন নারী হিসেবে সে বসে থাকে? এই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল অর্ধেক নর ও অর্ধেক নারী নিয়ে। ঘর-সংসার থেকে শুরু করে যে নারী পুরুষের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রে সম্মানের সঙ্গে অবস্থান করে নিজের, পরিবারের ও রাষ্ট্রের সুনাম বজায় রাখছে সেই নারী কেন সহ্য করবে তার সন্তানদের নষ্টকারীদের?

ফতোয়ায় স্বাক্ষরকারী নারী আলেমরা একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। বিশ্বে এই প্রথমবারের মতো একসঙ্গে এতসংখ্যক মুসলিম নারী একত্রে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ইসলাম শান্তির ধর্ম। কাউকে খুন করা অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামও সমর্থন করে না। কিন্তু ইসলাম ধর্মের অপব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে জঙ্গিরা জঙ্গিবাদকে জায়েজ করার চেষ্টা করে। এই ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়াটা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে। এর মাধ্যমে পরিষ্কার হবে যে দেশের আলেম সমাজও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর ফলে মহিলা আলেমরা অন্তত মাদ্রাসা বা তাঁদের ইসলামিক আলোচনায় জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা সম্পর্কে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে সবাইকে সচেতন করে তুলতে পারবেন। গত দেড় বছরে লেখক, প্রকাশক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, বিদেশি নাগরিক, হিন্দু পুরোহিত, খ্রিস্টান যাজক, বৌদ্ধ ভিক্ষুর ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে একই কায়দায় হামলার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মত পাওয়া গেলেও এই প্রথম ইসলামিক ধর্মীয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে এ ধরনের মেসেজ পাওয়াটা এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক অর্থ বহন করে। তবে এখানেই থেমে গেলে চলবে না। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে নারীদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তবেই দেশ থেকে জঙ্গিবাদকে চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব হবে।