আমাদের সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ ও কিছু কথা

PIN silvia-lenny

মানুষের ইতিহাস পড়লে দেখা যায় শুরুতে মানুষের সঙ্গে অন্য প্রাণীর কোনও পার্থক্য ছিল না। বরং মানুষ ছিল অসহায় এক প্রাণী। সে পৃথিবীতে বিচরণ করা অন্য অতিকায় ও শক্তিশালী প্রাণীর তুলনায় খুবই নিরীহ। তার ধারালো দাঁত নেই, তার শক্তিশালী থাবা নেই। সে গায়ে গতরে বা শক্তিতেও অন্য বণ্য প্রাণীদের চেয়ে দুর্বল।

তবে এই পৃথীবিতে মানুষ টিকে থাকার জন্য অন্য এক অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করলো। এমন একটি অস্ত্র যেখানে অন্য প্রাণীদের চেয়ে সে যোজন যোজন এগিয়ে। তার বুদ্ধি। বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে মানুষ অন্য শক্তিশালী প্রাণীদের থেকে নিজেকে শুধু সুরক্ষাই করতে শিখেনি বরং তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করল। শুধু তাই নয়, মানুষ তার নিজের খাবার, বাসস্থান, পোশাক পরিচ্ছেদ ইত্যাদির জন্য অন্য সকল প্রাণীর প্রতি নৃশংস হওয়া শুরু করলো। আর আধুনিক যুগে ত মানুষ শুধু নিজের টিকে থাকার প্রয়োজনেই নয়, বরং খেলাধুলা, আমোদের জন্যও অন্য প্রাণীদের ইচ্ছামত ব্যবহারে মন দিল।

মানুষ নিজের প্রয়োজনে শুধু পশুদের উপর নৃশংশতা করেই থেমে থাকেনি। সে যখন খাবারের জন্য ঘুরে ভেড়ানো থেকে মুক্তি পেল অর্থাৎ স্থির হলো, তখন সে শুরু করলো ক্ষমতার চর্চা। সে পশুপাখির উপর আধিপত্য বিস্তারের পর নিজে নিজেদের মধ্যেই শ্রেষ্ট হতে চাইল। তার স্বজাতি অন্যদের চেয়ে ক্ষমতাবান হয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে সচেষ্ট হল মানুষ।

ইতিহাসবিদ, নৃবিজ্ঞানীরা পৃথীবির ইতিহাস ও মানুষের ইতিহাসের এমনই একটি চিত্র তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে। এরপর বলতে পারি মানুষ নানা গোত্র, নানা সমাজে ভাগ হয়ে নিজেদের আধিপত্যের চর্চা করতে লাগলো। ভাগ হওয়ার প্রবনতা এতই বেশি হলো যে একই গোত্রের, বর্ণের মধ্যেই সে নারী ও পুরুষে ভাগ হওয়া শুরু করল। শুধু মাত্র ভিন্ন লিঙ্গ হওয়ার কারণে একে অন্যের উপর আধিপত্যের চেষ্টা করলো। এই ভাগ হওয়ার খেলায় যুক্ত হল ধর্ম।

ধর্ম নিয়ে মানুষ বিভক্ত হওয়ার শুরুর পর দেখা গেল একই ধর্মের মানুষ দেশ, জাতি, গোত্র, বর্ণ নির্বিশেষে ধর্মের মিলের কারনে তারা আলাদা হয়ে গেল। কিছু লোক ধর্মের নামে শুরু করলো অন্য ধর্মের উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা।

মোটাদাগে আমরা বলতে পারি, যেদিন থেকে মানুষের ‘মানুষ’ পরিচয়ের চেয়ে তার বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, লিঙ্গ বড় পরিচয় হয়েছে সেদিন থেকেই সাম্প্রদায়িকতার শুরু। নিজের সম্প্রদায়ের আধিপত্য অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার এই চেষ্টা মানবজাতির ইতিহাস। আমরা এই ইতিহাসকে অস্বিকার করে বা আলোচনা না করে এখনকার সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আলোচনা করতে পারি না। মানুষ যেখানে আছে সেখানে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা আছে। এটা তার দোষ বা গুন যাই বলা হোক, কিন্তু এটাই তার চরিত্র।

এখন আধুনিক সময়ে এসে মানুষ দাবি করতে শুরু করলো সে একটি সভ্য প্রাণী।  মানুষ দাবি করে সে সভ্য হয়েছে। সভ্যতার অন্যতম শর্ত হল সে মানবিক হবে। তার মাঝে নৃশংসতা থাকবে না। তাই সাম্প্রদায়িকতা তাকে পরিহার করতেই হবে। সে চেষ্টাও শুরু করলো। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের এই স্বভাব মানুষ পুরোপুরি ছাড়তে পারেনি। তাই সুযোগ পেলেই সেই চেহারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি বিষয় ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। আলোচিত হওয়ার মতই ঘটনা। প্রিয়া সাহা নামের একজন এনজিও কর্মী মার্কিন মুল্লুকের হর্তাকর্তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে গিয়ে নালিশ দিয়েছেন। এই নালিশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সরকারের উর্ধ্বতন যায়গা থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত। নানা জনের নানা মত।

প্রথমেই আমাদের জানা ভালো প্রিয়া সাহার অভিযোগটা মিথ্যা। যার ফলে তার সংগঠন হিন্দু-বৌদ্ধ -খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ তা গ্রহণ করেনি। তারা প্রিয়া সাহাকে কেন্দ্রীয় কমিটির পদ থেকে সাময়িকভাবে বহিস্কার করেছে।

এছাড়া অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতের তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি এই কথা বলেছেন বলে দাবি করেছেন। আবুল বারাকাত এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তার গবেষণার তথ্য বিকৃত করে উপস্থাপন করেছেন প্রিয়া সাহা। আবুল বারাকাতের বিবৃতিটি ছিল এমন, ‘প্রিয়া সাহা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ পত্র-পত্রিকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমার নাম উল্লেখপূর্বক কিছু তথ্য-উপাত্ত বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। প্রিয়া সাহা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতকালে বলেছেন যে, বাংলাদেশে ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লাখ) হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নিখোঁজ রয়েছেন। এর পরে ভিডিও-সাক্ষাতকারে তিনি আমরা নাম উল্লেখ করে বলেন যে, উল্লেখিত পরিসংখ্যান আমার গবেষণা উদ্ভূত তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি এও বলেছেন যে- বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ৬৩২ জন লোক হারিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়া সাহার উপরোক্ত বক্তব্যসমূহের সাথে আমার গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্তের কোনো মিল নেই। ’

সুতরাং আমাদের আর বুঝতে বাকি নেই প্রিয়া সাহার অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। তার বক্তব্যের নতুন ব্যবচ্ছেদ করা বা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করার প্রয়োজন নেই।

এখন আমার ভাববার যায়গা ভিন্ন। প্রিয়া সাহার নালিশের পর আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। আমার কাছে মনে হয়েছে প্রিয়া সাহার নালিশের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে দল-মত নির্বিশেষে মানুষের সাম্প্রদায়িক মুখোশ খসে পড়েছে। একজন ব্যাক্তির দায় অনেকেই চাপিয়ে দিয়েছেন একটা গোষ্টির উপর। কেউ গেলেন তার বিরুদ্ধে মামলা করতে। কে কিভাবে পারে প্রিয়া সাহাকে শায়েস্তা করবেন শুরু হল তার প্রতিযোগিতা। এটাই মানুষের স্বভাব। তার দীর্ঘদিনের চরিত্র সে পুরোপুরি লোকিয়ে রাখতে পারেনা। যা উপরেই আলোচনা করেছি।

প্রিয়া সাহার নালিশের পর সবচেয়ে বাজে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এদেশের সোশ্যাল মিডিয়ার বড় সংখ্যক ব্যবহারকারীরা। আর সবচেয়ে দারুণ কাজটি করেছেন আদালত ও সরকার। আদালত প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করেননি। আবার প্রধানমন্ত্রী ও  আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, ‘প্রিয়া সাহার বক্তব্য শুনতে হবে আগে।’ আদালত ও সরকারের এরকম অবস্থান প্রশংসনীয়।

তবে এখানে আমাদের সরকারের কর্তব্যও আছে বলে মনে করি। এখন সরকারের উচিত প্রিয়া সাহার এই নালিশের মোটিভ খুঁজে বের করা। কারণ এর আগেও আমরা দেখেছি, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া একই সুরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে কলাম লিখেছেন। সেখানেও নানা নালিশ করে বাংলাদেশকে চাপে রাখার আহবান জানানো হয়েছিল। সেরকম কোনো রাজনৈতিক ইন্ধন আছে কি না তা সরকাররের জানা উচিত। কারণ এরকম ঘটনা ঘটালে দেশে সামাজিক অস্থিরতা শুরু হয়। সুযোগ সন্ধানীরা সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর সুযোগ পায়। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বাড়লে যে কোনো কোনো গোষ্টির লাভ হয় তা ত আমাদের জানা।

প্রিয়া সাহা নিজে এই অসত্য তথ্য উপস্থাপন করেছেন নাকি তাকে দিয়ে কোনও স্বার্থান্বেষী মহল এই নিন্দনীয় কাজটি করিয়েছে জানা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য জরুরী। কারণ প্রিয়া সাহা যদি শুধুমাত্র এই স্ক্রিপ্টের একটা চরিত্র হয়ে থাকে তাহলে এই স্ক্রিপ্টের রচয়িতা এখানেই থেমে যাবে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। তাই অবশ্যই এমন কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা আমাদের উচিত হবে না যাতে করে প্রিয়া সাহা বাংলাদেশে ফিরে আসতে রাজি না হয়। এমনটা হলে আমরা আর কোন ভাবেই জানতে পারবো না পেছনের কুশীলব কারা ছিল। আর তিনি যদি মামলার কারণে আসতে না পারেন তবে তা হবে তার অভিযোগেরই সত্যতা দেওয়া।

অন্য যে প্রশ্নটি আমাকে ভাবাচ্ছে, তা হল প্রিয়া যদি প্রিয়া সাহা না হয়ে প্রিয়া ইসলাম হত, তাহলে কি আমাদের প্রতিক্রিয়া একই রকম হত নাকি আমরা অন্যভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতাম ? এই প্রশ্নটি নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের ভাবা জরুরী। নিজেকে সভ্য ও আধুনিক দাবি করতে হলে আচরণ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

একটা কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে প্রিয়া সাহার উপস্থাপিত সংখ্যা মিথ্যা হলেও, তথ্য বিকৃত হলেও, উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও  সারাদেশে সংখ্যালঘুরা যে স্বল্প সংখ্যায় হলেও নির্যাতিত হয় না এটা মনে করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কোনও কারণ নেই। প্রিয়া সাহার মিথ্যার বিপরীতে সত্যটাও আমরা জানি এবং সেটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

এই মুহুর্তে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সাম্প্রদায়িকতা। ভারত আজ সাম্প্রদায়িক সমস্যায় অস্থির। মিয়ানমারে একেরপর এক দাঙ্গা। শ্রীলংকায় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ, পাকিস্তানে শিয়াদের উপর নির্যাতন। তুলনামুলক বিচার করলে বাংলাদেশেই বরং ধর্মভিত্তিক কোনও দাঙ্গা বা বিভাজন সেই অর্থ নেই তবে সামাজিক ব্যাধির মত এই সাম্প্রদায়িক সমস্যা কিছুটা আছেই।

আমাদেরকে খুব সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টির ব্যখ্যা করতে হবে। কোনও উপসংহার বা চূড়ান্ত মন্তব্য করার আগে বর্তমান পরিস্থিতি, বাস্তবতাসহ সবকিছুই টেবিলে রেখে আলোচনা করতে হবে।

যদি একেবারে খোলামেলা করেই বলি তাহলে বলতে দ্বিধা নেই এদেশের সংখ্যালঘুদের পক্ষের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলটিই এখন ক্ষমতায়। শুধু যদি আমরা চাকরীর ক্ষেত্রটি দেখি তাহলে দেখা যায় অতীতে এক্ষেত্রে যে ধর্মীয় বৈষম্য হারহামেশাই হত তা এখন আর নেই। ধর্মীয় উৎসব পালনে নেই অতীতের মত বাঁধা। এখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ধর্মীয় উৎসব পালন করতে গেলে সরকার সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। এখনকার সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনাগুলো মানুষের মনে সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ। তা কোনোভাবেই রাষ্ট্রের করা বৈষম্য নয়। বরং রাষ্ট্র এখন আগের যে কোনও সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অসাম্প্রদায়িক। এখন আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের উপর কোনও নির্যাতনের ঘটনাকে দেখতে হবে একটু ভিন্ন চোখে। এখন তা বিচ্ছিন্ন ঘটনাই বলা যায়। তবে এটাও স্বিকার করে নিতে দ্বিধা থাকা উচিত নয় , যে আগের মত না হলেও কিছু মাত্রায় সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটছে। এই যে কিছু মাত্রায় হচ্ছে, তাই আমাদের নাক কাঁটা যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই সরকারকে একেবারেই তা নির্মূল করতে হবে।

আমাদের উচিত প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। প্রকৃত চিত্র সামনে না এনে, বিবেচনায় না নিয়ে কোনো উপসংহার টানা সচেতনতার লক্ষন নয়। আর এখন যে সময় এসেছে, জাতি হিসেবে আমরা সচেতন না হলে বিশ্বের দরবারে টিকে থাকাটাই কঠিন।