বেপরোয়া পরিবহন আর কত জীবন নিবে?

PIN বেপরোয়া পরিবহন আর কত জীবন নিবে?

মানুষ তাদের প্রাত্যহিক কাজের মধ্যেই সময় করে টিভি ও সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখার পাশাপাশি এবং সকালের চায়ের সঙ্গে পত্রিকা নিয়ে বসার অভ্যাসটাও একেবারে উবে যায়নি। সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমজুড়ে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের খবরের দিকে কৌতূহলবশতঃ উঁকি দেওয়ার পরে বিষণ্ণ গয়ে উঠলো মন। রাজনৈতিক উত্তেজনা ছাপিয়ে ভেসে উঠেছে বাস চাপায় নিহত শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষাথীর মুখ। এরপর পিতামাতার আহাজারি, সহপাঠীদের আর্তনাদের ভারী হয়ে ওঠা রাজধানীর পরিবেশ স্থিরচিত্র বা দৃশ্যচিত্র হিসেবে ফেসবুকে ঘুরছে। কোনও সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এমন সংবাদ সহ্য করা সম্ভব না।

এমনিতেই ঢাকা শহরের মানুষদের মৃল্যবান সময় নষ্ট হয় রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের কারণে। আর একটু বৃষ্টির পানি হলেই তো সড়ক হয়ে যায় নদী। নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত ঢাকাবাসী এখন যানবাহনচালকদের দৌরাত্ম্যের শিকারে পরিণত হয়েছে। এই বছরই রাজধানীতে বাসচাপায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেক। রাস্তা পার হতে গিয়ে মৃত্যু যেমন আছে, তেমনি চলমান দুই বাসের মধ্যে চাপা পড়ার ঘটনাও আছে, এমনকি এক বাসের স্টাফ অন্যবাসের চাপায় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, এমনকি দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে নদীতে ফেলে হত্যা করার অভিযোগও উঠেছে বাসচালক-হেলপারের বিরুদ্ধে।

গাড়িতে উঠলেই তারা আগ্রাসী হয়ে যাচ্ছে কেনো? এসবের মানে কি? গণপরিবহন সেক্টর অনেকদিন থেকেই দুর্ঘটনার কারণে আলোচনায়। কিন্তু তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে কখনোই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। তাদের এতো ক্ষমতার উৎস কী! আজকাল স্কুল-কলেজের বাচ্চাদেরও প্রতিবাদ করতে মাঠে নামতে হচ্ছে। এসব কোনও ভালো লক্ষণ নয়। গণমাধ্যমের সংবাদ অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী এসব কারণে সম্প্রতি নৌ-পরিবহন মন্ত্রীকে তিরস্কার করেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও বিব্রত বলে প্রকাশ্যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। পরিবহন সেক্টর নিয়ে সরকার যে বিব্রত তা স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করছেন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা।

রাজধানীর রাস্তায় স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করতে নেমেছে, তারা গাড়ি থামিয়ে জানতে চাচ্ছে- লাইসেন্স আছে? যদি থাকে তাহলে গাড়ি যেতে দেওয়া হচ্ছে, নাহলে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটছে। রাস্তায় থেকে ছাত্রদের সরাতে পুলিশও তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত সময় পার করছে। গাড়ির ফিটনেস থাক না থাক, ড্রাইভারের লাইসেন্স থাক না থাক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশের হাতেতো লাইসেন্স আছে।

সুতরাং তারা অ্যাকশনে যেতে পারে। স্কুল-কলেজের ইউনিফর্মধারীদের ওপর পুলিশি অ্যাকশন কোনও বীরত্বের বিষয় নয়, এসব ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের ছবি ছড়িয়ে পড়লে সরকারকে আরও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। মূল সমস্যা দুর্ঘটনা, পরিবহন সেক্টরের দৌরাত্ম্য। এটির স্থায়ী সমাধান এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ বলে: দুর্ঘটনা সংক্রান্ত সংবাদ, সেমিনার ও বিভিন্ন আলোচনায় যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো- আমাদের দেশের বেশিরভাগ চালক লেখাপড়া জানে না, তাদের রোড সাইন সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা নেই। গাড়ি চালানোর সময় কোথায় ওভারটেক করা যাবে এবং কোথায় যাবে না সে বিষয়ে তাদের কোনও ধারণা নেই। অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিতদের হাতে জিম্মি আমাদের সন্তাদের জীবন। যার ফলে প্রতিদিন সড়কে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে।

সড়ক দুর্ঘটনা হয় না এমন দেশ নেই। তবে উন্নত দেশগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা খুবই সুনির্দিষ্ট হয়। বাইরের দেশের চালকদের দেখেছি , নিয়ম দেখেছি, গাড়ি দেখেছি; তাদের তো এত দৌরাত্ম্য দেখিনি! বাংলাদেশে এখন এই সেক্টরের যা অবস্থা এটা স্পষ্ট দৌরাত্ম্য। দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতার কারণেই এটি চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। লাগাম টানা কঠিন হয়ে পড়েছে এখন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলা যায় প্রায় একা যখন দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন তখন অনেক দায়িত্বশীলদের কর্মকাণ্ডই তার সব অর্জনকে সাধারণ মানুষদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। দায়িত্বশীলদের মতো দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে না পারলে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়াই উচিত। আমাদের নেত্রী আপনাদের দায়ভার নিতে পারবেন না। আমরা যাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করি অথবা যারা কোনও প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদ থেকে নিম্নপদে থাকেন, প্রত্যেকের একটা দায়িত্ব থাকে; তারা সেই ভাবে দায়িত্ব পালন করবেন কিন্তু প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব যার- সড়ক দুর্ঘটনার খবরে তাদের কোনও ব্যক্তির প্রশস্ত হাসির দৃশ্য জনমনে ক্ষোভ সঞ্চার করে।

কোন মন্ত্রী যদি ভারতের সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩ জনের নিহত হওয়ার সঙ্গে এই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কম সংখ্যাকে তুলনা করেন তাহলে নাগরিক হিসেবে আমাদের মধ্যে চূড়ান্ত হতাশা কাজ করে। কারণ, আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি। আমরা আমাদের সন্তানদের ভালবাসি। আপনাদের ছেলে মেয়েরা হয়তো বড় বড় নাম করা স্কুলে যায় দামি ব্রান্ডের গাড়িতে চড়ে। দেশের অধিকাংশ মানুষেরই সেই সামর্থ্য নেই। তাই বলে কী আমাদের ছেলে-মেয়েদের এভাবে মেরে ফেলা হবে? আজ যদি আপনাদের (গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের) ছেলেমেয়েকে এইভাবে কোনও গাড়ি পিষে মেরে ফেলতো। তাহলে কি করতেন?

এতোদিনে স্পষ্ট হয়ে গেছে- আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ চালকদের বেপরোয়া গতি, রাস্তায় রেস করা এবং ইচ্ছামতো যেখানে সেখানে ওভারটেক করা। এছাড়াও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির না থাকায় তাদের দৌরাত্ম্য থামছেই না। যেহেতু বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটায় বাস এবং ট্রাক। তাই বিআরটিএ কৃর্তক বাস এবং ট্রাকের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৬০-৭০ কি.মি. নির্ধারণ করে দিয়ে স্পিড লিমিট গভর্নর সিল সংযুক্ত করে দিলে একজন চালক ইচ্ছামতো নির্ধারিত গতির অধিক গতিতে গাড়ি চালাতে পারবে না। দানবীয় গতির পাল্লা থামাতে এটি একটি ব্যবস্থা হতে পারে।

এছাড়াও ভাল যান, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক, সড়ক ব্যবস্থা উন্নতকরণ, সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিক ও যুগোপযোগী করার বিষয়গুলো তো রয়েছেই। একদিকে ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো রাস্তা থেকে সরিয়ে এবং অন্যদিকে শুধু দক্ষ, লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকদের গাড়ি চালানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমে আসবে। সেই সঙ্গে চালক, যাত্রী ও পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেও অনেক অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। একই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত আইনে শাস্তির বিষয়টিও বিবেচনা করা দরকার।

আমাদের বুঝতে হবে- সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক ও ক্ষত সৃষ্টি করে না, ওই পরিবারকে আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলে। কোনও কোনও দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি প্রাণ হারান। তখন ওই পরিবারের যে কী অবস্থা হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর যারা পঙ্গুত্ববরণ করেন, তাদের পরিবারের অবস্থা আরও করুণ, আরও শোচনীয়। দুর্ঘটনার কারণে একদিকে চলে যায় মানুষের প্রাণ আর অপরদিকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংশ্লিষ্ট সবাই। তাছাড়া নষ্ট হয় দেশের সম্পদ।

একটি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেকগুলো চোখ সারা জীবন ধরে কেঁদে চলে। টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মলিন হয়ে ওঠে সার্বিক উন্নতির ঝলমলে চিত্র! জনমনে খেদ বাড়ে, সার্বিক পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে!